অর্থ পাচারের শীর্ষে গার্মেন্ট মালিকরা

ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার থামছে না, চলছে মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসার আড়ালেও ২০৩০ সালে ১৪.১৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে পাচার, চলে যাচ্ছে করের ৩৬ শতাংশ পরিমাণ টাকা
জানা গেছে- দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকরা পুনঃ রপ্তানির শর্তে শুল্কমুক্ত বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধায় পণ্য আমদানির সুবিধা পান। কিন্তু সেই সুবিধার অপব্যবহার করে তাদের অনেকেই চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েছেন। খোলা বাজারে বিক্রি করছেন পণ্য। আবার তৈরি পণ্য রপ্তানি করেই প্রকৃত আয় দেশে আনছেন না। এভাবেই আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের শীর্ষে রয়েছেন পোশাকশিল্প মালিকরা।ঢাকায় ‘ডেলিভারিং এসডিজি ইন বাংলাদেশ : রোল অব নন স্টেট অ্যাক্টরস’ শীর্ষক সভায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ‘এসডিজির চার বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি-জিএফআই বলেছে- আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রতি বছর যে ভয়াবহ আকারে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালে এটি ১৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থ পাচারের এই প্রবণতা ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি সফলভাবে বাস্তবায়নে বাংলাদেশের ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাধাগ্রস্ত করবে।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা-আঙ্কটাড স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) নিয়ে গত বছর ২০ নভেম্বর প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে- আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে সিংহভাগ অর্থ পাচার হয়। গত চার বছরে টাকা পাচারের পরিমাণ আরও বেড়েছে। বাংলাদেশে বছরে যত টাকা কর আদায় হয়, তার ৩৬ শতাংশের সমান টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়। ২০১৫ সালে কী পরিমাণ কর আদায় হয়েছিল, তা বিবেচনা করে অর্থ পাচারের হিসাব করেছে আঙ্কটাড। সংস্থাটি বলছে- আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের মাধ্যমে করফাঁকি রোধ করা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। উন্নত দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বাণিজ্য হয়, এর ৭ শতাংশের সমপরিমাণ মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে হয়। আঙ্কটাডের পক্ষে ওই প্রতিবেদনটি ঢাকায় প্রকাশ করেছে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি। সংস্থাটির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন- টাকা পাচারের ৮০ শতাংশই হয় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে। টাকা পাচার রোধ করা গেলে কর আহরণ আরও বাড়ত। ওই টাকা দেশেই বিনিয়োগ হতো। খ্যাতনামা এই অর্থনীতিবিদের মতে- বেশি দামের জিনিসকে কম দাম দেখিয়ে পাঠানো হচ্ছে এবং সেটার ভিত্তিতে কম টাকা দেশের ভিতরে আসছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত দাম দেখিয়ে রপ্তানি করা হলেও টাকা আদৌ দেশের ভিতরে আসেনি। অনেক সময় পণ্য আমদানি-রপ্তানির ঘোষণা থাকলেও বাস্তবে খালি কনটেইনার আসা-যাওয়া করেছে, এমন উদাহরণও রয়েছে।
জানা গেছে- বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার আড়ালে সংঘবদ্ধ চক্র প্রতি বছর এক লাখ কোটি টাকা লুটপাট করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। লুটের সিংহভাগ অর্থই পাচার হচ্ছে বিদেশে। বন্ড লুটেরা মাফিয়া গ্রুপের অপরাধ-অপকর্ম কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। পোশাকশিল্প মালিকরা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প খাতকে জিম্মি করে সব সুবিধা চুষে নিচ্ছেন, লুটে নিচ্ছেন পুঁজির টাকা। চিহ্নিত এ মাফিয়া চক্রের বেশুমার প্রভাবের কাছে কাস্টমস, পুলিশ, ব্যবসায়ী মহল থেকে শুরু করে শিল্প-বাণিজ্য খাতের নীতিনির্ধারকরা পর্যন্ত ধরাশায়ী হয়ে পড়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করতেও সাহস পাচ্ছেন না কেউ। বন্ড অপব্যবহারবিরোধী অভিযানকারী কাস্টমস কর্মকর্তাকে তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার মতো দাপটও দেখিয়েছে ওই মাফিয়া চক্রটি। এভাবেই বছরের পর বছর অজ্ঞাত ক্ষমতার জোরে সবাইকে জিম্মি করে তারা যা ইচ্ছা তাই করে চলছেন। এতে করে কাগজ, কাপড়, প্লাস্টিকসহ দেশীয় শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ধ্বংস হতে চলেছে গোটা শিল্প খাত। সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার। সবকিছুই চলছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। তারা দেখেও না দেখার ভান করে রাষ্ট্রীয় লুটপাটের বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে শুল্ক গোয়েন্দা ও বন্ড কমিশনার করেনটা কী-তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে ব্যবসায়ী মহলে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা কাস্টসম বন্ড কমিশনারেটের কমিশনার ড. এস এম হুমায়ূন কবির গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন- বন্ডের পণ্যে শুল্ক ফাঁকি হচ্ছে। পোশাকশিল্প মালিকরা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কাপড় বিক্রি করছেন। এসব শুল্ক ফাঁকি ও চোরাচালানের বিরুদ্ধে সামনে বড় ধরনের অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ব্যাপক পরিমাণে সুতা ও কাপড় খোলা বাজারে বিক্রি হয়েছে। এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা আসছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মবিনুল কবীর গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন- অর্থ পাচার প্রতিরোধে কাজ করছে শুল্ক গোয়েন্দা। তার মতে- দেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ী ভালো। এর মধ্যে কিছু কিছু গার্মেন্ট মালিক আছেন, যারা শুল্কমুক্ত বন্ড সুবিধায় পণ্য এনে খোলা বাজারে বিক্রি করেন। এখন তাদের ধরব।
জানা গেছে- শুল্ক ও কর ফাঁকিবাজ এবং অর্থ পাচারকারী ওইসব পোশাকশিল্প মালিকের বিরুদ্ধে মালিকপক্ষ বিজিএমইএকে অ্যাকশন নিতে বলেছে এনবিআর। একই সঙ্গে বন্ড লাইসেন্স প্রাপ্ত পোশাক কারখানাসমূহের আমদানি করা কাঁচামাল সঠিকভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করা ও সরকারের প্রতিরোধমূলক কর্মকান্ডে বিজিএমইএর সহযোগিতাও চেয়েছে এনবিআর। বন্ড সুবিধায় আমদানি হওয়া গার্মেন্ট পণ্যের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিজিএমইএর সহযোগিতা চেয়ে গত বছর ৩ অক্টোবর দেওয়া পত্রে এসব কথা বলেছে এনবিআর। পত্রে বলা হয়- ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ও বিজিএমইএর পত্রসমূহ পর্যালোচনা করেছে এনবিআর। এতে ৬৩টি পোশাক কারখানার বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধা অপব্যবহারের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ৬৩টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় তদন্তসাপেক্ষে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণে বিজিএমইএকে অনুরোধ করা হয়।
ওই পত্রের জবাবে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক গত ৯ অক্টোবর এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে দেওয়া পত্রে বলেছেন- বিজিএমইএ বন্ড লাইসেন্স পাওয়া পোশাক কারখানাসমূহের আমদানি হওয়া কাঁচামাল সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে সব কর্মকান্ডে সহযোগিতা করার আশ্বাস প্রদান করছে। বন্ড সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ধরনের সমস্যা যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির মাধ্যমে সমাধান করা শ্রেয় হবে।
জানা গেছে- শুল্কমুক্ত পণ্য চোরাচালানে বিক্রির সঙ্গে জড়িত ৬৩টি পোশাক কারখানার প্রায় সবগুলোই কালোবাজারে পণ্য বিক্রির সময় হাতেনাতে ধরা পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক জরিমানা ছাড়াও কারও কারও আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থগিত করেছে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। তালিকায় অভিযুক্ত এমন ১০টি প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের একাধিকবার কালোবাজারে পণ্য বিক্রির সময় হাতেনাতে ধরা হয়েছে। এ নিয়ে অর্থমন্ত্রীও সরব। বন্ডেড সুবিধায় মালামাল এনে তা কালোবাজারে বিক্রি করে দেওয়ায় এবং স্থানীয় বস্ত্রশিল্পের প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এ নিয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে অর্থমন্ত্রীও নির্দেশ দিয়েছেন। জানা গেছে- বন্ডেড সুবিধায় আনা পোশাক শিল্পের কাঁচামালের শুল্ক-করের পরিমাণ প্রকারভেদে ৬০ শতাংশ থেকে ১১০ শতাংশ কিংবা তার চেয়েও বেশি হারে পরিশোধ করতে হয়। চোরাকারবারিতে জড়িত পোশাক কারখানা প্রতিষ্ঠানগুলোর শুল্ক করফাঁকির তথ্যও এনবিআর বিজিএমইএর কাছে পাঠিয়েছে। এতে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিস ১৬টি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি ধরেছে, যার মাধ্যমে ৩৫ কোটি ৩১ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। কাস্টমস গোয়েন্দা বিভাগ ১২টি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম উদঘাটন করে ২৭৫ কোটি টাকা আদায় করেছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ১টি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম উদঘাটন করে ১৩ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় করেছে। চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে যাতে রাজস্বের পরিমাণ ৪৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া ঢাকা কাস্টম হাউস ৩টি, বেনাপোল কাস্টম হাউস ৮টি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি চিহ্নিত করেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি- জিএফআই সর্বশেষ গত ৩ মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেছে- বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বাণিজ্যের আড়ালে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। যা মার্কিন মুদ্রায় হিসাবে গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। বাংলাদেশ প্রতিদিন